বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার কি হাল?

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার কি হাল?


সৃজনশীল প্রশ্ন -

সৃজনশীল প্রশ্নটা খুবই ভালো এবং প্রশংসনীয় একটা জিনিস। তো সৃজনশীল উত্তর হতে হবে সৃজনশীলতা সম্পন্ন। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই সৃজনশীলতা দেখানোরই পথ রূদ্ধ।

সৃজনশীলতা কখনো নিয়ম মেনে হয় না, কোনো নিয়মের বাধ মানে না। আর আমাদের ব্যবস্থায়? সৃজনশীল প্রশ্নের 'গ' হতে হবে তিন প্যারায়, 'ঘ' হতে হবে চার প্যারায়। শুরু হতে হবে এই নিয়মে, শেষ হতে হবে ওই নিয়মে... আরে বাবা এত নিয়মকানুন থাকলে আবার এটা কীসের সৃজনশীল? কোনো যুক্তি আছে?

একটা বড় অংশের শিক্ষার্থী আছে যারা প্রশ্ন মুখস্থ করে, শিক্ষকেরাই বা কি করে? শিক্ষার্থীরা মাসের পর মাস প্রস্তুতি নিয়ে পাহাড়সম মানসিক চাপ নিয়ে ৩ ঘন্টা বসে বসে যত্ন করে পরীক্ষা দেয়। যেই পরীক্ষার খাতায় শিক্ষার্থী তার সবটুকু ঢেলে দিয়েছে সেই খাতা কিনা একজন শিক্ষক '৩০' সেকেন্ডে দেখে ফেলেন, শিক্ষার্থীরা কি লিখেছে কিভাবে লিখেছে তা দেখারই তো সময় নাই, সৃজনশীলতা দেখবে কিভাবে।

আমি নিজেই এর প্রমাণ, আমি কোনোদিনও প্রশ্ন মুখস্থ করিনা, এমনকি গাইড পর্যন্ত খুলি না। পক্ষান্তরে একশ্রেণির তথাকথিত 'ভালো শিক্ষার্থীরা' প্রশ্ন মুখস্থ করে পরীক্ষায় হোম রান মারে। আমার মা আমাকে জিজ্ঞাসা করে ওরা পারলে আমি পারি না কেন? আমি উত্তর দেই যে ওরা ফার্মের মুরগি আর আমি দেশি মুরগী(😅)। আমি কি বুঝিয়েছি বুঝেছেন আশা করি। তো এই হলো আমাদের সৃজনশীল ব্যবস্থা, যেখানে সৃজনশীলতা দেখানো নিষেধ।

একই জিনিস সবাইকে গিলানো -

যারা স্মার্টফোনের ফ্যাক্টরি দেখেছেন তারা জানেন সেখানে কিভাবে ফোন প্যাক করা হয়। একই মডেলের ফোনের একই প্যাকেজিং, একই ম্যানুয়েল, সব একই। আবার ভিন্ন মডেলের ফোনের সবকিছুই ভিন্ন। আমরা মানুষরা সবাই এক মডেলের না, মানে একরকম না। আমাদের প্রত্যেকের আগ্রহ, ইচ্ছা, চিন্তাধারা ইত্যাদি সব ভিন্ন।

কিন্তু আমাদের সাজানো হচ্ছে একইভাবে। সবার একই সিলেবাস, একই বই সবকিছু একই। কেন, বিষয় একই থাকুক কিন্তু আমাদের ভিন্ন লেখকের বই থাকুক, অপশন থাকুক, আমরা নিজেদের আগ্রহ মতো যেটা ইচ্ছা সেটা নিই। সেটা করবে না, আচ্ছা এটার কথা বাদ দিন। বইয়ের ভাষাই দেখুন। ২০২ সালের মাধ্যমিকের বই সম্পাদনা করা হয়। আগেরটার কথা তো বাদই দিলাম,এখন বর্তমানেরটার কথাই বলি।

এমন কাঠখোট্টা ভাষায় লিখা হয়, আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় এরা একটা বই লিখার পর ছাত্রদের কাছে পাঠিয়ে দিক, এরপর ছাত্ররা মিলে এটাকে কিছুটা সহজপাঠ্য করুক...

গাইড বই, কোচিং সেন্টার ইস্যু -

শিক্ষাবিদদের কথা হলো কোনো গাইড পড়া যাবে না, শুধু পাঠ্যবই পড়তে হবে। কোচিং এ যাওয়া যাবে না, শুধু স্কুলে পড়লেই হবে।

আচ্ছা শিক্ষার্থীরা গাইড কেন পড়বে না বলুন তো?

ফিজিকস, কেমিস্ট্রি এসব বইয়ে অঙ্ক কষার কার্যকরী সূত্র তো দূরে থাক, ঠিকমতো নমুনা প্রশ্নও দেওয়া থাকে না। কেউ গাইড না দেখে শুধু এসবের বই পড়ে পরীক্ষা দিতে গেলে দেখবে যে সব প্রশ্ন মাথার নিচে দিয়ে যাচ্ছে।

আর ক্লাসে যে কেমন পড়া হয় সেটা আর বললাম না (আমি সেরা স্কুলদের কথা বলছি না, সারা বাংলাদেশে হিসাবে বলছি)। আমি একজন শিক্ষকের কাছে শুনেছিলাম আমাদের স্কুল নাকি বাংলাদেশের ৮ম স্কুল, অথচ এখানে দশ বছরে ২০০-২৫০ জন শিক্ষকের মাঝে আমি ১৫ জন সত্যিকার শিক্ষকও পেয়েছি কিনা সন্দেহ। এই যদি হয় ক্লাসের অবস্থা তাহলে শিক্ষার্থীরা কেন ব্যাচ, কোচিং এ পড়বে না?...

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার কি হাল?


ছাত্রদের কেন পড়ার জন্য জোড় করতে হয় -

এটা বিশেষভাবে বাংলাদেশের সমস্যা। আচ্ছা আউট বইয়ের কথা বলি। গল্পের বইয়ের কথা ভুলে যান, আসলেই শিক্ষামূলক বই।

যেমন-

ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়।

এগুলাও পড়ার বই আর স্কুলের বইও পড়ার বই। তাহলে কেন স্কুলের বই শিক্ষার্থীরা পড়ে অনিচ্ছায় আর আউট বই পড়ে সদিচ্ছায়? এটার মূল উত্তর আগেই দেওয়া হয়েছে।

আরো পড়ুন: কম পড়ে বিসিএস ক্যাডার প্রিলিমিনারি পাসের নিঞ্জা টেকনিক

সবাইকে একজিনিস গেলানো আর বিরক্তিকর কাঠখোট্টা লিখার ধরন। অসুস্থ ব্যক্তি বমি বমি ভাব করলে তাকে যখন খাবার দেওয়া হয়, দায়ে পড়ে ঠিকই পেট ভরে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বমি করে সব বের করে দেয়। আমরাও পড়ি পরীক্ষার জন্য, পরীক্ষার খাতায় সব বের করে দিয়ে আসি...

শিক্ষার অর্থ -

মা-বাবা'রা আমাদের বলেন, একটু ভালোমতো না পড়লে একটা চাকরি পাবা? ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে না? এখন সমস্যা হচ্ছে আমরা শিক্ষার অর্থ ভুলে গিয়ে এটাকে দক্ষতার সাথে গুলিয়ে ফেলেছি।

একজন একটা ডিগ্রি নিয়ে হলো সিএসই ইঞ্জিনিয়ার, একজন ডাক্তার, একজন ডিজাইনার। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি সব একেকটা দক্ষতা, স্কিল। এর সাথে শিক্ষার সম্পর্ক কোথায়? দক্ষতাই যদি শিক্ষা হতো তাহলে আমি গাড়ি চালানো শিখে বলতাম যে আমি ড্রাইভার, তো আমি শিক্ষিত। হাস্যকর না?

এই দক্ষতা দিয়ে কি হবে, যেই দক্ষতা বাটপারি, চুরি, দুর্নীতি না করতে শেখায় না?....

অতিরিক্ত কিছু কথা -

যারা খেয়াল করেন তারা দেখেছেন গত ৫০-৬০ বছরে কোনো মৌলিক আবিষ্কার হয়নি, কোনো বিখ্যাত দার্শনিক আসেনি, পলিম্যাথ রাও বিলুপ্তপ্রায়। এখন কেউ দয়া করে তেড়ে আসবেন না। গত অর্ধশতাব্দীতে প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে যেমন সত্য, তেমনই সত্য এগুলার বেশিরভাগই পুরাতন আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে হয়েছে।

এসি কারেন্ট, ডিসি কারেন্ট দুটা যুগান্তকারী আবিষ্কার, মোবাইল ফোন একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার, টিভি একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার। এরকম যুগান্তকারী মৌলিক আবিষ্কার কয়টি হয়েছে বলুন তো?

দার্শনিক, পলিম্যাথ আসা তো আরো আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এর কারণটা উনিশ শতকের পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা। এখন বিজ্ঞানী ফার্মে চাষ করা হয়, দার্শনিকও ফার্মে চাষ করা হয়। চার বছরের ফিলোসোফির উপর একটা ডিগ্রি নিয়ে হয় দার্শনিক। আগেকার দার্শনিকরা নিজে চিন্তাভাবনা করে বিভিন্ন কিছু বের করতো, আর এখন তারা কি চিন্তা ভাবনা করতো বই-খাতায় তা পড়ানো হয়।

আর পলিম্যাথ হলো যাদের একসাথে অনেকগুলা দক্ষতার উপর আধিপত্য আছে, এখন আমাদের ব্যাবস্থায় ১৫-২০ বছর সময় নেওয়া হয় একটা দক্ষতা অর্জনের জন্য। পলিম্যাথ আসবে কিভাবে।

আমেরিকান কোটিপতি ব্রায়ান ট্রেসি কে নিশ্চয় চিনেন, উনি কোটিপতি হওয়ার আগে কোনো ডিগ্রি নেন নাই, কোটিপতি হওয়ার পর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলেন সেখানে কি শেখায় দেখার জন্য। তার মতে যারা সেখানে ব্যাবসা শেখায় তারা নিজেরাই বুঝে না ব্যাবসা কি।

বিশ্বের ৮০% বিলিওনিয়ারের কোনো ডিগ্রি নেই। এর মাধ্যমে এটাই বোঝা যায় টাকার সাথে পড়াশোনা করার কোনো সম্পর্ক নেই।

যাই হোক, অনেকক্ষণ বকবক করলাম। যারা এতক্ষণ পড়েছেন তাদেরকে ধন্যবাদ এবং ধৈর্যের জন্য ভার্চুয়াল রসগোল্লা দিয়ে শুভেচ্ছা।
Previous Post Next Post