বিশ্বসভ্যতা
আদিম যুগে মানুষ কৃষিকাজ বা কোন চাষাবাদ জানত না। বন-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে পশু-পাখি ফলমূল সংগ্রহ করত। এগুলোই ছিল তাদের খাদ্য।
এরপর মানুষ পাথর ভেঙে ঘষে ঘষে ধারালো অস্ত্র তৈরি করতে শেখে। সে সময় পাথরই ছিল তাদের একমাত্র হাতিয়ার। সে কারণে ঐ যুগকে পাথরের যুগ বলা হয়।
পাথর যুগের প্রথম পর্যায়কে বলা হতো পুরনো পাথরের যুগ বা পুরোপলীয় যুগ। এ যুগে মানুষ পাথর দিয়ে দলবদ্ধভাবে পশু-পাখি শিকার করত। এরা আগুনের ব্যবহারও জানতো এবং করতো।
মানুষ যখন কৃষিকাজ শেখে তখন পুরনো পাথরের যুগ শেষ হয়, একই সঙ্গে শেষ হয় তার যাযাবর জীবন। এার পরের যুগকে বলা হয় নতুন পাথরের যুগ বা নবোপলীয় যুগ।
কৃষির প্রয়োজনে এযুগে মানুষ নদীর তীরে তীরে বসবাস শুরু করে। ঘর-বাড়ি নির্মাণ করতে শেখে। এভাবেই মানব সভ্যতার শুরু।
এই আর্টিকেলে কীভাবে মানুষ ধাপে ধাপে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তারই সত্য কাহিনী। যে সভ্যতাগুলো থেকে প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস জানা যায় এমনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
যেমন:
- মিশরীয় সভ্যতা
- মোসোপটেমীয় সভ্যতা
- সিন্ধু সভ্যতা
- চীন সভ্যতা
- গ্রিক সভ্যতা
- রোমান সভ্যতা।
মিশরীয় সভ্যতা
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার বিস্তৃতিকাল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০-৫২৫ পর্যন্ত। আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব অংশ যা আমাদের কাছে পরিচিত মিশর বা ইজিপ্ট নামে।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে মিশরে প্রথম সাম্রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। যার একটি ছিল উত্তর মিশর (নিম্ন মিশর) অপরটি ছিল দক্ষিণ মিশর (উচ্চ মিশর)।
খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত সময়ে নীলনদ কেন্দ্র করে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সে সময়টা প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে প্রাক-রাজবংশীয় যুগ বলে।
প্রথম রাজবংশের শাসন আমল শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ থেকে। তখন থেকে মিশরের ঐতিহাসিক যুগের শুরু। একই সময়ে নিম্ন ও উচ্চ মিশরকে একত্রিত করে ‘নারমার’ বা ‘মেনেস’ একাধারে মিশরের প্রথম নরপতি এবং পুরোহিত হন। তিনি প্রথম ফারাওএর মর্যাদাও লাভ করেন। এরপর থেকে ফারওদের অধীনে মিশর প্রাচীন বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতিতে একের পর এক উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে শুরু করে।
সভ্যতায় প্রাচীন মিশরীয়দের অবদান
বিশ্বসভ্যতায় প্রাচীন মিশরীয়দের গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
রাষ্ট্র ও সমাজ প্রাক-রাজবংশীয় যুগে মিশর কতগুলো ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এগুলোকে ‘নোম’ বলা হতো। মিশরের প্রথম রাজা বা ফারাও-এর (মেনেস বা নারমার) অধিনে ঐক্যবদ্ধ মিশরের রাজধানী ছিল দক্ষিণ মিশরের মেম্ফিস।
মিশরীয় ‘পের-ও’ শব্দ থেকে ফারাও শব্দের জন্ম। ফারওরা ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। তারা নিজেদেরকে সূর্য দেবতার বংশধর মনে করতেন। ফারাও পদটি ছিল বংশানুক্রমিক। অর্থাৎ ফারাওয়ের ছেলে হতো উত্তরাধিকার সূত্রে ফারাও।
পেশার উপর ভিত্তি করে মিশরের সমাজের মানুষকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
যেমন:
- রাজপরিবার
- পুরোহিত
- অভিজাত
- লিপিকার
- ব্যবসায়ী
- শিল্পী
- কৃষক
- ভ‚মিদাস
মিশরের অর্থনীতি মূলত ছিল কৃষি নির্ভর। নীল নদের তীরে গড়ে তোলা সভ্যতার মানুষ অর্থাৎ মিশরীয়রা বন্যার সময় বাঁধ তৈরি করে ফসল রক্ষা করত। আবার শুষ্ক মৌসমে ফসলের ক্ষেতে পানি দেয়ার জন্য খাল কেটে গড়ে তুলেছিল সেচ ব্যবস্থা। মিশরেই প্রথম সরকারি ব্যবস্থায় চাষাবাদ চালু হয়।
কৃষিনির্ভর মিশরের উৎপাদিত ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-
- গম
- যব
- তুলা
- পেঁয়াজ
- পিচ
- ইত্যাদি
ব্যবসায়-বাণিজ্যেও মিশর ছিল অগ্রগামী। মিশরে উৎপাদিত গম, লিনেন কাপড় ও মাটির পাত্র ক্রিট দ্বীপ, ফিনিশিয়া, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় রপ্তানি হতো।
বিভিন্ন দেশ থেকে মিশরীয়রা স্বর্ণ, রৌপ্য, হাতির দাঁত, কাঠ ইত্যাদি আমদানি করতো।
নীল নদ:
মিশরের নীল নদের উৎপত্তি আফ্রিকার লেক ভিক্টোরিয়া থেকে। সেখান থেকে নদটি নানা দেশ হয়ে মিশরের মধ্য দিয়ে ভূ-মধ্যসাগরে এসে পড়েছে।ইতিহাসের জনক ‘হেরোডোটাস’ যথার্থই বলেছেন- ‘মিশর নীল নদের দান।’
নীল নদ না থাকলে মিশর মরুভূমিতে পরিণত হতো। প্রাচীন কালে প্রতিবছর নীল নদে বন্যা হতো। বন্যার পর পানি সরে গেলে দুই তীরে পলিমাটি পড়ে জমি উর্বর হয়ে যেতো। জমে থাকা পলিমাটিতে জন্মাতো নানা ধরনের ফসল।
মিশরীয়দের ধর্ম বিশ্বাস
প্রাচীন মিশরীয়দের মতো অন্য কোনো জাতি জীবনের সকল ক্ষেত্রে এতটা ধর্মীয় নিয়ম-কানুন অনুশাসন দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। সে কারণে মানবসভ্যতার অনেক ধ্যানধারণা, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠানের জন্ম প্রাচীন মিশরে।
তারা জড়বস্স্তুর পূজা করত, মূর্তি পূজা করত, আবার জীবজন্তুর পূজাও করত। বিভিন্ন সময়ে তাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটেছে।
মিশরীয়দের ধারণা ছিল, সূর্যদেবতা ‘রে’ বা ‘আমন রে’ এবং প্রাকৃতিক শক্তি, শস্য ও নীলনদের দেবতা ‘ওসিরিস’ মিলিতভাবে সমগ্র পৃথিবী পরিচালিত করেন। তবে তাদের জীবনে সূর্যদেবতা ‘রে’-এর গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি।
পিরামিড
মিশরীয়রা মনে করত মৃত ব্যক্তি আবার একদিন বেঁচে উঠবে। সে কারণে দেহকে তাজা রাখার জন্য তারা মৃতদেহ সংরক্ষণ করত। এই পদ্ধতিকে বলা হয় মমি। এই চিন্তা থেকে মমিকে রক্ষার জন্য তারা পিরামিড তৈরি করেছিল। ফারাওরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করতেন। ফারাওরা ছিলেন প্রধান পুরোহিত এবং অন্যান্য পুরোহিতদেরও তাঁরা নিয়োগ করতেন।
শিল্প
মিশরের চিত্রশিল্পও গড়ে উঠেছিল ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। মিশরীয়দের চিত্রকলা বিশেষভাবে বৈচিত্রপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
মিশরের চিত্রশিল্পের সূচনা হয় সমাধি আর মন্দিরের দেয়াল সাজাতে গিয়ে। তাদের প্রিয় রং ছিল সাদাকালো। সমাধি, পিরামিড, মন্দির, প্রাসাদ, প্রমোদ কানন, সাধারণ ঘর-বাড়ির দেয়ালে মিশরীয় চিত্রশিল্পীরা অসাধারণ ছবি এঁকেছেন। এসব ছবির মধ্যে মিশরের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কাহিনী ফুটে উঠেছে।
কারুশিল্পেও প্রাচীন মিশরীয় শিল্পীরা অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। আসবাবপত্র, মৃৎপাত্র, সোনা, রূপা, মূল্যবান পাথরে খচিত তৈজসপত্র, অলঙ্কার, মমির মুখোশ, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, হাতির দাঁত ও ধাতুর দ্রব্যাদি মিশরীয় কারু শিল্পের অসাধারণ দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।
প্রাচীন মিশরীয় শিল্পকর্ম স্ফিংকস
ভাস্কর্য
প্রাচীন বিশ্বসভ্যতায় মিশরীয়দের মতো ভাস্কর্য শিল্পে-অসাধারণ প্রতিভার ছাপ আর কেউ রাখতে সক্ষম হয়নি।
ব্যাপকতা, বৈচিত্রময় এবং ধর্মীয় ভাবধারায় প্রভাবিত বিশাল আকারের পাথরের মূর্তিগুলো ভাস্কর্য শিল্পে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। প্রতিটি ভাস্কর্য, মানুষ অথবা জীবজন্তু সবই ধর্মীয় ভাবধারা, আচার অনুষ্ঠান, মতদার্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
প্রতিটি শিল্পই আসলে ধর্মীয় শিল্পকলা। সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য হচ্ছে গির্জার অতুলনীয় স্ফিংকস। স্ফিংকস হচ্ছে এমন একটি মূর্তি, যার দেহটা সিংহের মতো, কিন্তু মুখটা মানুষের মতো। মিশরের সবচেয়ে বড় পিরামিডটি হচ্ছে ফারাও খুফুর পিরামিড। মন্দিরগুলোতে মিশরীয় ভাস্কর্য স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।
লিখনপদ্ধতি ও কাগজ আবিষ্কার
মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল লিপি বা অক্ষর আবিষ্কার। নগর সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিশরীয় লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। তারা সর্বপ্রথম ২৪টি ব্যঞ্জনবর্ণের বর্ণমালা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয় প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে।
প্রথম দিকে তারা মনের ভাব প্রকাশ করত বিভিন্ন ছবি এঁকে । এই লিখন পদ্ধতির নাম ছিল চিত্রলিপি। এই চিত্রলিপিকে বলা হয় ‘হায়ারোগি ফিক’ বা পবিত্র অক্ষর। মিশরীয়রা নলখাগড়া জাতীয় গাছের মন্ড থেকে কাগজ বানাতে শেখে। পরে এই কাগজের উপর তারা লিখতে শুরু করে। গ্রিকরা এই কাগজের নাম দেয় ‘প্যাপিরাস’। যে শব্দ থেকে ইংরেজি ‘পেপার’ শব্দের উৎপত্তি।
এখানে উল্লেখ্য নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মিশর জয়ের সময় একটি পাথর আবিষ্কৃত হয়, যা “রসেটা স্টোন” নামে পরিচিত। এতে গ্রিক এবং ‘হায়ারোগি ফিক’ ভাষায় অনেক লেখা ছিল; যা থেকে প্রাচীন মিশরের অনেক তথ্য জানা যায়।
বিজ্ঞান
মিশরীয় সভ্যতা ছিল কৃষিনির্ভর। সে কারণে নীল নদের পানি প্রবাহের মাপ, প্লাবন, নাব্যতা, জোয়ারভাটা ইত্যাদি ছাড়াও জমির মাপ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এসবের সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্র ও অংক শাস্ত্রের ছিল গভীর যোগাযোগ। ফলে এ দুটি বিদ্যা তারা আয়ত্ত করেছিল প্রয়োজনের তাগিদে। তারা অংক শাস্ত্রের দুটি শাখা- জ্যামিতি এবং পাটিগণিতেরও প্রচলন করে।
মিশরীয় সভ্যতার মানুষ যোগ, বিয়োগ ও ভাগের ব্যবহার জানত। খ্রিস্টপূর্ব ৪২০০ অব্দে তারা পৃথিবীতে
প্রথম সৌর পঞ্জিকা আবিষ্কার করে। ৩৬৫ দিনে বছর এ হিসাবের আবিষ্কারকও তারা।
প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা সময় নির্ধারণের জন্য সূর্য ঘড়ি, ছায়াঘড়ি, জলঘড়ি আবিষ্কার করে। ধর্মের কারণে মিশরীয়রা বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহী ছিল।
চিকিৎসাশাস্ত্রেও প্রাচীন মিশরীয়ানরা বিশেষ অগ্রগতি লাভ করে। তারা দাঁত, চোখ ও পেটের রোগ নির্ণয় করতে জানত। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করার বিদ্যাও জানতো তারা।
হাড় জোড়া লাগানো, হৃৎপিন্ডের গতি এবং নাড়ির স্পন্দন নির্ণয় করতে পারত। চিকিৎসা শাস্ত্রে মিশরীয়রাই সর্বপ্রথম ‘মেটেরিয়া মেডিকা’ বা ঔষুধের তালিকা প্রণয়নে সক্ষম হয়।
মিশরীয়ানরা দর্শন, সাহিত্য চর্চাও করত। তাদের রচনায় দুঃখ হতাশার কোন প্রকাশ ছিল না। তারা আশাবাদী ছিল। তাদের লেখায় সব সময়ই আনন্দের প্রকাশ দেখা গেছে।
সারসংক্ষেপ
প্রাচীন মিশরীয়ানরা মানব সভ্যতার ইতিহাসে গৌরবময় স্থান দখল করে আছে। মানব সভ্যতার অগ্রগতি তাদের অবদানে অটুট। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে তাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নির্মাতা বলা যায়। চিত্রকলায় আছে বিশেষ বৈচিত্রপূর্ণ অবদান।
লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন, সেচ ব্যবস্থা চালু, চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র অংক শাস্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
সভ্যতার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করেছিল এই মিশর। যে কারণে মানব জাতি এখনও মিশরীয়দের কাছে ঋণী।